মানুষকে পানি পান করানোর ইবাদত এর ফযীলত সম্পর্কে হাদীদ বর্ণিত হয়েছে।
ধর্ম ডেস্ক :
গ্রীষ্মের তাপপ্রবাহে পুড়ছে দেশ। সর্বত্র হাহাকার একটু বৃষ্টির জন্য, একটু স্বস্তির জন্য। সাময়িক স্বস্তির জন্য কেউ বিশেষ স্থানে তৃষ্ণার্ত মানুষকে ঠান্ডা পানি পান করাচ্ছে। তাদের পিপাসিত উদরকে পরিতৃপ্ত করছে। এটা নিঃসন্দেহে উত্তম ও সওয়াবের কাজ। এই কাজের প্রতি উৎসাহ প্রদান করা উচিত। পানি পান করানো নিজের এবং নিজের মৃতদের জন্য সদকায়ে জারিয়ার একটি উৎস। নবীজি (সা.)-এর হাদিসে মানুষ এমনকি পশুদের জন্যও পানির ব্যবস্থাকারীকে বেহেশতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে। তাই পানি পান করানোর বিষয়টি দেখতে ছোট হলেও এটি মহা সওয়াব ও মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ
ঠান্ডা পানি আল্লাহর নেয়ামত
নবীজি (সা.) দোয়া করতেন, ‘হে আল্লাহ! তোমার ভালোবাসাকে আমার আত্মা, আমার পরিবার ও ঠান্ডা পানি হতে বেশি প্রিয় করে দাও’ (তিরমিজি : ৩৪৮০)। এখানে মহান আল্লাহর ভালোবাসাকে ঠান্ডা পানির ভালোবাসার চেয়েও বড় বলা হয়েছে। যা থেকে জানা যায়, ঠান্ডা পানিও একটি মহান নেয়ামত।
পানি পান করানো সদকায়ে জারিয়া
নবীজি (সা.)-এর হাদিসে পানি পান করানোকে সদকায়ে জারিয়া হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। যার সওয়াব মৃত্যুর পরও পাওয়া যায়। গরিব-দুঃখী ও অসহায় ব্যক্তিদের মাঝে বোতল, গ্লাস, ট্যাঙ্ক ইত্যাদি যেকোনো মাধ্যমে পানির ব্যবস্থা করা মৃতদের জন্য সদকায়ে জারিয়া হতে পারে। সাদ ইবনে উবাদাহ (রা.) সূত্রে বর্ণিত, তিনি বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! উম্মু সাদ মৃত্যুবরণ করেছেন। (তার পক্ষ হতে) কোন সদকা সর্বোত্তম হবে? তিনি বললেন, পানি। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি (সাদ) একটি কূপ খনন করে বললেন, এটা উম্মু সাদের (কল্যাণের) জন্য ওয়াকফ।’ (আবু দাউদ : ১৬৮১)
সর্বোত্তম সদকা
পানি পান করানো অত্যন্ত উত্তম সদকা। হাদিসে এর প্রতি উৎসাহী করা হয়েছে। ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সর্বোত্তম সদকা হলো পানি পান করানো। তোমরা কি জাহান্নামীদের সে কথা শোননি, যখন তারা জান্নাতবাসীদের কাছে পানি চেয়ে বলবে, ‘আমাদের ওপর কিছু পানি অথবা তোমাদেরকে আল্লাহ যে রিজিক দিয়েছেন, তা আমাদের ওপর ঢেলে দাও। তারা বলবে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তা কাফেরদের ওপর হারাম করেছেন’ (মুসনাদে ইবনে আব্বাস : ৬২৭৩)। অপর এক হাদিসে নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমকে এমন স্থানে পানি পান করাল, যেখানে তা সহজলভ্য; সে যেন একটি গোলামকে মুক্ত করল। আর যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমকে এমন স্থানে পানি পান করাল, যেখানে তা দুষ্প্রাপ্য; সে যেন তাকে জীবন দান করল।’ (ইবনে মাজাহ : ২৪৭৪)
আল্লাহর ক্ষমা লাভ
যদিও পানি পান করানোর কাজটি খুবই সহজ। তবুও এটি একটি মহান সওয়াব, প্রভুর সন্তুষ্টি এবং ক্ষমা লাভের কারণ। শুধু এই কর্মের কারণেই একজন ব্যক্তি জাহান্নাম থেকে মুক্তি পেতে পারে এবং বেহেশতের যোগ্য হতে পারে। হাদিসে এসেছে, আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘একজন লোক রাস্তা দিয়ে চলতে চলতে তার ভীষণ পিপাসা লাগল। সে কূপে নেমে পানি পান করল। এরপর সে বের হয়ে দেখতে পেল যে, একটা কুকুর হাঁপাচ্ছে এবং পিপাসায় কাতর হয়ে মাটি চাটছে। সে ভাবল, কুকুরটারও আমার মতো পিপাসা লেগেছে। সে কূপের মধ্যে নামল এবং নিজের মোজা ভরে পানি নিয়ে মুখ দিয়ে সেটি ধরে উপরে উঠে এসে কুকুরটিকে পানি পান করাল। আল্লাহ তায়ালা তার আমল কবুল করলেন এবং আল্লাহ তার গোনাহ মাফ করে দিলেন। সাহাবিগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! চতুষ্পদ জন্তুর উপকার করলেও কি আমাদের সওয়াব হবে? তিনি বললেন, প্রত্যেক প্রাণীর উপকার করাতেই পুণ্য রয়েছে।
(বুখারি : ২৩৬৩)।
জান্নাতের সুধা পান
দুনিয়াতে পানি পান করানোর সওয়াব এত বেশি যে, এই পানির বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা ব্যক্তিকে কিয়ামতের দিন জান্নাতের পানি পান করাবেন। হাদিসে উল্লেখ আছে, আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত, নবীজি (সা.) বলেছেন, ‘কোনো মুসলিম তার কোনো বিবস্ত্র মুসলিম ভাইকে কাপড় পরিধান করালে আল্লাহ তায়ালা তাকে জান্নাতের সবুজ পোশাক পরিধান করাবেন। কোনো মুসলিম তার ক্ষুধার্ত মুসলিম ভাইকে খাবার খাওয়ালে আল্লাহ তায়ালা তাকেও জান্নাতের ফল খাওয়াবেন। কোনো মুসলিম তার কোনো তৃষ্ণার্ত মুসলিম ভাইকে পানি পান করালে আল্লাহ তায়ালা তাকেও মোহরাঙ্কিত জান্নাতি সুধা পান করাবেন। (আবু দাউদ : ১৬৮২)
জান্নাতের নিকটবর্তী হওয়ার সুযোগ
মানুষকে পানি পান করানো এমন একটি কাজ যা তাদেরকে জান্নাতের নিকটবর্তী করে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখে। বর্ণিত হয়েছে, একজন গ্রাম্য ব্যক্তি নবীজির খেদমতে এসে জিজ্ঞেস করল, আমাকে এমন কিছু আমল বলে দিন, যা আমাকে মহান আল্লাহর আনুগত্যের নিকটবর্তী করবে এবং জাহান্নাম থেকে দূরে রাখবে। নবীজি (সা.) বললেন, তুমি কি তা অনুসরণ করবে? তখন তিনি বললেন, হ্যাঁ। তখন রাসুল (সা.) বললেন, ইনসাফের কথা বল এবং অতিরিক্ত জিনিসপত্র অন্যদের দিয়ে দাও।
তিনি বললেন, আল্লাহর কসম! আমি না ইনসাফের কথা বলতে পারি, না অতিরিক্ত সম্পদ অন্যদের দিতে পারি। নবীজি (সা.) বললেন, খাবার খাওয়াও এবং সালাম দাও। তিনি বললেন, এটাও কঠিন। নবীজি (সা.) বললেন, তোমার কাছে কি উট আছে? সে বলল, হ্যাঁ।
অতঃপর নবীজি (সা.) বললেন, একটি উট ও একটি মশক নিয়ে নাও। এরপর যারা মাঝে মাঝে পানি পায়, তাদের বাড়িতে যাও। তাদেরকে পানি পান করাও। (আস-সুনানুল কুবরা লিল-বায়হাকি : ৭৫৯৮)
অগণিত সওয়াব লাভ
মানুষ কেবল মানুষের তৃষ্ণা নিবারণের জন্যই যে পুরস্কার পায় তা নয়। বরং একটি ক্ষুধার্ত প্রাণীকে খাওয়ানো এবং তাকে পান করানোর জন্যও পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। হজরত সুরাকা বিন জুশুম (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, আমি নবী কারিম (সা.)-এর অসুস্থতার সময়ে তার খেদমতে উপস্থিত হলাম। আমি নবীজি (সা.)-এর কাছে প্রশ্ন করতে শুরু করলাম। এমনকি আমার প্রশ্ন সব শেষ হয়ে গেল।
তখন নবীজি (সা.) আমাকে বললেন, আরও কিছু মনে করো। ওই প্রশ্নগুলোর মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল, হে আল্লাহর রাসুল! আমি আমার উটের জন্য পানির যে চৌবাচ্চা তৈরি করে রেখেছি, পথ ভুলে আসা উটও তা থেকে পানি পান করে। আমি যে সেটিকে পানি পান করতে দিলাম, তাতে কি আমার সওয়াব হবে?
তিনি বলেন, হ্যাঁ, প্রত্যেক প্রাণীর বেলায় সওয়াব রয়েছে (মুসনাদে আহমদ : ১৭৬২৪)। মোটকথা, তৃষ্ণার্তকে পানি পান করানো, পানির চাহিদা পূরণ করা দেখতে ছোট হলেও এটি মহা সওয়াব ও উচ্চ মর্যাদার কারণ। আল্লাহ তায়ালা আমাদের আমল করার তওফিক দান করুন।
যেমন একদা সা‘দ বিন ওবাদাহ (رضي الله عنه) নবী করীম (ﷺ)-এর নিকট এসে বললেন, আপনার নিকট কোন ছাদাক্বা সর্বাধিক পসন্দনীয়? তিনি বললেন, পানি পান করানো।’ (আবুদাঊদ হা/১৬৭৯; হাকেম হা/১৫১১)।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (ﷺ) বলেন, পানি পান করানো অপেক্ষা অধিক ছওয়াবপূর্ণ ছাদাক্বা আর নেই।’
(বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৩৩৭৮; ছহীহ আত-তারগীব হা/৯৬০)।
সা‘দ বিন ওবাদাহ (رضي الله عنه) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, হে আল্লাহর রসূল! উম্মু সা‘দ মৃত্যুবরণ করেছেন, (তার পক্ষ হ’তে) কোন ছাদাক্বা সর্বোত্তম হবে? তিনি বললেন, পানি পান করানো। বর্ণনাকারী বলেন, তিনি একটি কূপ খনন করে বললেন, এটা উম্মু সা‘দের (কল্যাণের) জন্য ওয়াকফ করা হ’ল।
(আবুদাঊদ হা/১৬৮১; মিশকাত হা/১৯১২)।
রাসূল (ﷺ) আরো বলেন, যে ব্যক্তি পানির কূপ খনন করল, আর সে কূপ থেকে মানুষ, জিন বা কোন পাখি পানি পান করল। এর বিনিময়ে আল্লাহ তাকে ক্বিয়ামতের দিন ছওয়াব প্রদান করবেন।
(ছহীহ ইবনু খুযায়মাহ হা/১২৯২; ছহীহ আত-তারগীব হা/৯৬৩)।
রাসূল (ﷺ) বলেছেন, আদম সন্তানের দেহে তিনশত ষাটটি হাড় বা জোড় বা গ্রন্থি রয়েছে। এগুলোর প্রতিটির জন্য প্রত্যেক দিন ছাদাক্বা রয়েছে। প্রতিটি উত্তম কথাই ছাদাক্বা। এক ভাইয়ের পক্ষ হ’তে অন্য ভাইকে সাহায্য করা ছাদাক্বা। এক ঢোক পানি পান করানো ছাদাক্বা। পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্ত্ত সরিয়ে দেওয়াও ছাদাক্বা’।"
(আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৪২২; ছহীহাহ হা/৫৭৬)।
এছাড়া জনৈকা বেশ্যা নারী একটি পিপাসার্ত কুকুরকে পানি পান করালে আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দেন।
(বুখারী হা/৩৪৬৭; মুসলিম হা/২২৪৫; মিশকাত হা/১৯০২)।