
পবিত্র হজ্ব ২০২৫ সামনে রেখে মক্কায় শুরু হয়েছে নানা প্রস্তুতি। তারই অংশ হিসেবে পবিত্র কাবা শরিফের গিলাফ বা কিসওয়া তিন মিটার উপরে তোলা হয়েছে। এই ঐতিহ্যবাহী পদক্ষেপটি প্রতিবছর হজের আগে সৌদি কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করে, যাতে হজযাত্রীদের প্রচণ্ড ভিড় ও স্পর্শে কিসওয়া ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং পবিত্র কাবার সুরক্ষা বজায় থাকে।
সৌদি আরবের হজ ও উমরাহ বিষয়ক প্রশাসন জানিয়েছে, এই কাজটি সম্পন্ন হয়েছে একটি বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত টিমের মাধ্যমে, যারা অত্যন্ত যত্ন ও ধর্মীয় মর্যাদা বজায় রেখে কিসওয়া উত্তোলনের কাজ করে। এই আয়োজন প্রতিবারই মুসলিমদের মধ্যে কাবাঘরের মর্যাদা ও সম্মান সম্পর্কে নতুন করে ভাবনার জন্ম দেয়। পবিত্র কাবাঘরের ওপর আবৃত যে কাপড়টি মুসলিম বিশ্বে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রতীক, সেটিই হলো কিসওয়া। আরবিতে একে বলা হয় কিসওয়া এবং বাংলায় আমরা সাধারণত বলি গিলাফ। এই পবিত্র আবরণ শুধু একটি কাপড় নয়, বরং এটি কাবাঘরের মর্যাদা, ইতিহাস ও মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের চিরন্তন প্রতীক।
কিসওয়ার ঐতিহাসিক সূচনা
ইতিহাসবিদ ইবনে ইসহাক ও ইবনে হিশাম জানিয়েছেন, ইয়েমেনের রাজা তুব্বা আবু কারিব আসাদ পঞ্চম শতাব্দীতে প্রথম কাবাঘরকে কিসওয়া দিয়ে আচ্ছাদিত করেন। রাজত্বকাল ৩৮৮-৪২০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে হলেও, তাঁর এই উদ্যোগ ইসলামপূর্ব যুগের গুরুত্বপূর্ণ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।
প্রথমে তিনি মদিনা আক্রমণ করতে চাইলেও ইহুদি ধর্মগুরুদের উপদেশে ধর্ম পরিবর্তন করে ইহুদি ধর্ম গ্রহণ করেন এবং পবিত্র কাবা সম্পর্কে জানতে পারেন। পরবর্তীতে তিনি মক্কায় এসে ছয়দিন অবস্থান করেন, কাবা তাওয়াফ করেন, কোরবানি দেন এবং কাবা ঘরকে তিন স্তরে বিভিন্ন মানের কাপড় দিয়ে আবৃত করেন।
কিসওয়ার বিবর্তন ও রঙের পরিবর্তন
শুরুতে কাবা আবৃত হতো ইয়েমেনি কাপড় যেমন খাসফ, মাফির, মিলা ও ওয়াসায়েল দিয়ে। পরবর্তীতে কিসওয়ার রঙ ও কাপড়ের মানও পরিবর্তিত হয় বিভিন্ন শাসকের আমলে—
রাসুলুল্লাহ (সা.) বিদায় হজে কাবাকে সাদা ও লাল ডোরাকাটা কাপড়ে আচ্ছাদিত করেন।
খুলাফায়ে রাশেদিন আমলে ব্যবহৃত হয় সাদা কিসওয়া।
আব্বাসীয় খলিফা আল-নাসির কালো রঙের ব্রোকেড কিসওয়ার প্রচলন শুরু করেন, যা আজও প্রচলিত।
সেলজুক সুলতান ব্যবহার করেন হলুদ ব্রোকেড।
আধুনিক যুগের কিসওয়া: সৌদি আরবের প্রযুক্তির ছোঁয়া
বর্তমানে কিসওয়া তৈরি হয় সৌদি আরবের “দ্য কিং আবদুল আজিজ কমপ্লেক্স ফর ম্যানুফ্যাকচারিং দ্য কাবা কিসওয়া” নামক কারখানায়। প্রতি বছর নতুন কিসওয়া তৈরিতে ব্যবহার করা হয়:
৬৭০ কেজি প্রাকৃতিক রেশম ও তুলা
১২০ কেজি সোনার প্রলেপ দেওয়া রুপার সুতা ক্যালিগ্রাফির জন্য
প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ সৌদি রিয়াল ব্যয়
কিসওয়া পরিবর্তনের নিয়ম
প্রথাগতভাবে প্রতি বছর জিলহজ মাসের ৯ তারিখে, আরাফার দিনে কিসওয়া পরিবর্তন করা হতো। তবে ২০২২ সাল থেকে এই রীতি পরিবর্তন করে ১ মহররম, হিজরি নতুন বছরের প্রথম দিনে কিসওয়া পরিবর্তন করা হচ্ছে।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও সম্মান
ইসলামের ইতিহাসে কিসওয়ার প্রেরণ ও সংরক্ষণ দায়িত্ব ছিল বিভিন্ন খেলাফত, সালতানাত ও শাসকের ওপর। হজ কাফেলার সঙ্গে কিসওয়া পাঠানো, পুরোনো কিসওয়া ফিরিয়ে আনা এবং নতুন কিসওয়া বসানোর প্রথা ছিল এক পবিত্র দায়িত্ব ও সম্মানজনক কাজ।