
আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে পক্ষপাতের অভিযোগ, বাড়ছে প্রশাসনিক অবহেলা ও ‘রিট বাণিজ্য’র বিস্তার
বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা, যা দেশের সাক্ষরতার চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত, সেখানে এক যুগান্তকারী আদালতের রায় বাস্তবায়ন নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। সারাদেশে ৬৫ হাজারেরও বেশি প্রধান শিক্ষক পদ থাকলেও মাত্র ৪৫ জন শিক্ষক পেয়েছেন উচ্চতর বেতন গ্রেড—যা আদালতের নির্দেশনায় নির্দেশিত ছিল সবার জন্য।
বহু বছরের আইনি লড়াইয়ের পর, চলতি বছরের মে মাসে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ৪৫ জন প্রধান শিক্ষককে দশম গ্রেডে উন্নীত করার নির্দেশ দেয়। যদিও সরকারি ভাষ্য এটিকে “দীর্ঘদিনের মর্যাদার স্বীকৃতি” বলছে, শিক্ষক সংগঠন ও দুর্নীতিবিরোধী কর্মীরা এটিকে “প্রশাসনিক উদাসীনতা ও কাঠামোগত বৈষম্যের নগ্ন উদাহরণ” বলে আখ্যায়িত করছেন।ন্যায্যতা—কিন্তু মাত্র ৪৫ জনের জন্য?
সরকারি তথ্য অনুযায়ী: অনুমোদিত প্রধান শিক্ষক পদ: ~৬৫,৬২০,নিয়মিত প্রধান শিক্ষক: ~৫০,০০০,ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক: ~১৫,০০০শূন্য পদ: ~১৮,০০০,দশম গ্রেড প্রাপ্ত শিক্ষক: মাত্র ৪৫ জন
২০১৯ সালে হাইকোর্ট রায়ে ঘোষণা দেয়—যোগ্য, অভিজ্ঞ প্রধান শিক্ষকদের দশম গ্রেডে বেতন প্রদানে প্রশাসন বাধ্য, এবং তাদের তথাকথিত “সংবিধিবদ্ধ হয়রানি” থেকে রক্ষা করা জরুরি।
কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর দাবি করছে, এই রায় শুধু রিট পিটিশন নং ৩২১৪/২০১৮-এর আবেদনকারীদের জন্য প্রযোজ্য, অর্থাৎ যে ৪৫ জন শিক্ষক মামলায় ছিলেন শুধুমাত্র তারাই উপকৃত হবেন।
এই ব্যাখ্যা শিক্ষক সমাজে প্রবল অসন্তোষ তৈরি করেছে। “এটা ন্যায়বিচার নয়,” বলেন উত্তরের এক শিক্ষক নেতা আফসার আলী।
“একই দায়িত্ব পালন করছি, একই পদে। শুধু আদালতে নাম ছিল না বলেই আমরা বঞ্চিত হবো? এটা বৈষম্য নয় তো কী!
জমজমাট হয়ে উঠছে ‘রিট বাণিজ্য’
দেশের বিভিন্ন উপজেলায় প্রধান শিক্ষকরা অভিযোগ করছেন—“নতুন করে রিট করার নামে ৫ থেকে ১১ হাজার টাকা পর্যন্ত” আদায় করা হচ্ছে।
নরসিংদীর এক শিক্ষক বলেন (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক): “উপজেলা অফিস থেকে বলা হয়েছে, টাকা দিলে নাম অন্তর্ভুক্ত হবে। এটাকে কি আর দাবি আদায় বলা যায়? এটা এখন একটা বাণিজ্য।”
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এই বিষয়ে স্বচ্ছ তদন্তের দাবি জানিয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন:“রায়টি নির্দিষ্ট ছিল। সকলের জন্য বাস্তবায়ন করতে হলে আলাদা আইনি প্রক্রিয়া দরকার। আদালতের নির্দেশনা ছাড়া আমাদের হাতে কিছু নেই।”
কিন্তু বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ব্যাখ্যা কৌশলে দীর্ঘসূত্রিতা বাড়ানোরই পথ। কারণ অধিকাংশ শিক্ষকই মামলা চালানোর খরচ বা প্রশাসনিক সংযোগের জোগাড় করতে পারেন না।
বাংলাদেশে আদালতের রায় আংশিক বা পক্ষপাতদুষ্টভাবে বাস্তবায়নের অভিযোগ নতুন নয়। তবে প্রাথমিক শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে এ ধরনের ঘটনার প্রভাব বহুগুণ।
শিক্ষা ও নীতি বিশ্লেষক ড. নাজনীন আখতার বলেন: “আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা খাত এমনিতেই হেয় অবস্থানে। সেখানে যদি আদালতের রায় কেবল হাতে গোনা কয়েকজনের জন্য প্রযোজ্য হয়, তাহলে প্রশ্ন ওঠে—ন্যায়বিচারের মানদণ্ড কি সবার জন্য এক?”
প্রভাব পড়ছে মাঠপর্যায়ে
দেশজুড়ে হাজার হাজার প্রধান শিক্ষক রয়েছেন, যারা দীর্ঘদিন ধরে স্কুল পরিচালনার দায়িত্বে আছেন।তাদের অনেকেই বলছেন—এই বৈষম্য মনোবল ভেঙে দিচ্ছে, ক্ষোভ বাড়াচ্ছে এবং শিক্ষার মানেও প্রভাব ফেলছে।
চট্টগ্রামের এক শিক্ষক বলেন: “আমরা শুধু ৪৫ জনের জন্য আন্দোলন করিনি। করেছিলাম সকলের অধিকারের জন্য।”
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি সুপ্রিম কোর্ট রায়ের প্রযোজ্যতা সবার জন্য ঘোষণা না করে, তাহলে এই সংকট দীর্ঘস্থায়ী হবে।
এদিকে শিক্ষকদের অভিযোগ—আইনি অধিকার পাওয়ার জন্য ঘুষ বা রাজনীতিক অনুগত্য লাগবে—এমন ধারণা শিক্ষার পরিবেশকে কলুষিত করছে।
এখনও দেশের হাজারো ক্লাসরুমে শিক্ষকরা নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করছেন, কিন্তু মনে মনে প্রশ্ন করছেন—“আমাদের মর্যাদা কি কেবল রিট করার সামর্থ্য বা সংযোগের ওপর নির্ভর করে?”