
উন্নত জীবনের আশায় স্বপ্নের ইউরোপ যাত্রায় লিবিয়া যেন হাজারো স্বপ্নবাজ বাংলাদেশি তরুণের দুঃস্বপ্নের মৃত্যু ফাঁদ তারা বলেছিল, সে ইতালিতে পৌঁছাবে। কিন্তু আমি যা পেলাম, তা ছিল একটি ফোন কল—জানানো হলো, আমার ভাই একটি জ্বালানিভর্তি নৌকার হুলে আটকে শ্বাসরোধে মারা গেছে, আরও আটজনের সঙ্গে।”
এই কথাগুলো কোনো গল্পের লাইন নয়। এটি একটি বাস্তব, মর্মান্তিক সত্য—যে সত্য এখন অসংখ্য বাংলাদেশি পরিবারকে গ্রাস করে চলেছে। ইউরোপে ভালো জীবনের মায়াজালে আটকে পড়ে তারা হারিয়ে ফেলছে প্রিয়জনদের—লিবিয়ার মরুভূমিতে বা ইউরোপগামী ভয়ঙ্কর সমুদ্রপথে। বছরের পর বছর ধরে লিবিয়াকে ইউরোপে পৌঁছানোর একটি সেতুবন্ধন হিসেবে দেখানো হয়ে এসেছে। কিন্তু হাজার হাজার বাংলাদেশির জন্য, এই সেতু হয়ে উঠেছে বন্দিত্ব, নির্যাতন ও মৃত্যুর এক নির্মম ফাঁদ।
বাংলাদেশি অভিবাসীদের একটি বড় অংশ তুরস্ক হয়ে লিবিয়ায় প্রবেশ করে, কেউ কেউ যায় সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মিশরের পথে। এদের অধিকাংশই তরুণ—বয়স বিশ থেকে ত্রিশের মধ্যে। তারা ৫ থেকে ১৬ লক্ষ টাকা খরচ করে—জমি বিক্রি করে বা উচ্চ সুদের ঋণ নিয়ে। তারা মনে করে, এই বিনিয়োগ তাদের একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ এনে দেবে। কিন্তু যা তারা কিনে, তা হচ্ছে নিজেদের বন্দিত্ব। BRAC মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের ২০২৪ সালের এক প্রতিবেদনে উঠে আসে ভয়ঙ্কর কিছু তথ্য:
৬৩% অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী লিবিয়ায় জোরপূর্বক আটক হন।
৭৮% শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন—প্রহার, অনাহার ও চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হন।
অনেক পরিবার ভিডিওতে তাদের ছেলেদের নির্যাতনের দৃশ্য দেখে; টাকা পরিশোধের পরও আবার নতুন অর্থ চাওয়া হয়।
কিছু তরুণের নখ তুলে নেওয়া হয়, ক্যামেরার সামনে। অনেকেই ধীরে ধীরে মারা যায়, বিনা চিকিৎসায়। সব টাকা দিয়ে দেওয়ার পরও অনেক পরিবার হারায় তাদের সন্তানকে।
সমুদ্রপথে গণকবর
তাদের অনেকেই এই ভয়ংকর গন্তব্যে পৌঁছাতেও পারেনি।
২০২৫ সালের জানুয়ারিতে লিবিয়ার উপকূলে একটি নৌকাডুবিতে ৫৬ জন অভিবাসী নিখোঁজ হন। অন্তত ২৩ জন বাংলাদেশির লাশ উপকূলে ভেসে ওঠে। এর এক মাস আগেই, একটি নৌকার জ্বালানি ট্যাংকে আটকে পড়ে শ্বাসরোধে মারা যান কয়েকজন বাংলাদেশি—তাদের তালা দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল।
Frontex-এর তথ্যমতে, ২০২৪ সালে লিবিয়া ও তিউনিসিয়া থেকে ইউরোপে পাড়ি জমানো অভিবাসীর সংখ্যা ছিল ৬৭,০০০-রও বেশি। এদের অনেকেই ছিলেন বাংলাদেশি। কিন্তু অনেকেই ইউরোপের মাটিতে পা রাখতে পারেননি। এটা কোনো বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা নয়—এটি একটি সুসংগঠিত ব্যবসা।
মানবপাচার এখন একটি শিল্পে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের স্থানীয় দালালরা লিবিয়ার পাচারকারীদের সঙ্গে সমন্বয় করে। ২০২৫ সালে, লিবিয়ার পথে ১৭ জন বাংলাদেশিকে পাচারের সময় একটি চক্র ধরা পড়ে। লিবিয়ার কর্মকর্তারা জানান—আটক কেন্দ্রে অভিবাসীদের কিনে-বেচা হয়। কখনো কখনো, তাদের আবার দালালের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়—”গার্ড” বা “সহায়তাকর্মী” সেজে। যদি কেউ বলে—”লিবিয়া হয়ে ইউরোপ যাবি”, বুঝে নিন, সে আপনাকে স্বপ্ন দেখাচ্ছে না। সে হয়তো অজান্তেই আপনাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
ভুল নৌকা ইউরোপে নিয়ে যায় না।
তা ডুবিয়ে দেয়—ভয়ঙ্কর সমুদ্রপথে।
আপনার স্বপ্ন হোক নিরাপদ, বাস্তবমুখী—জীবনের ঝুঁকিতে নয়।
বাংলাদেশের তরুণেরা যেন জীবন হারায় না—এটা আমাদের সকলের দায়িত্ব। কলামিস্ট -Rayhan Kabir
Migrant Rights Specialist