
২০২৪ সালের ১লা সেপ্টেম্বর, এক হিন্দু ছাত্রীর যৌন হয়রানির অভিযোগ ঘিরে ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। অভিযুক্ত ছিলেন মোহাম্মদ আরিফ নামে এক মুসলিম নরসুন্দর, যিনি পরে পালিয়ে যান।
এরপর শহরের হিন্দু ব্যবসায়ী সমিতি প্রতিবাদে নামে, যেখানে হাসানসহ মুসলিমরাও অংশ নেয়। কিন্তু সেই মিছিলেই শুরু হয় ‘মুসলমানদের দালালদের জুতা মেরে তাড়াও’ ধরণের বিদ্বেষমূলক স্লোগান, যা একপর্যায়ে সহিংসতায় রূপ নেয়। এক মুসলিম যুবক, হারুন আনসারিকে জনতা মেরে ফেলে রেখে যায়।
সেই রাতেই মুসলিম পরিবারগুলোর বাড়িতে পাথর নিক্ষেপ, দোকানপাট ভাঙচুর শুরু হয়। কেউ পুলিশের ফোন ধরেনি, প্রতিবেশী হিন্দু বন্ধুরাও নিরুত্তর। প্রাণভয়ে গভীর রাতে শহর ছেড়ে পালিয়ে যান প্রায় সব মুসলিম পরিবার। একমাত্র ফিরে আসেন আহমদ হাসান ও তার পরিবার।
হাসানের দোকান “দ্য হাসান ড্রাই ক্লিনার্স” সম্পূর্ণভাবে লুটপাট করা হয়, তার সন্তানের বিয়ের জন্য সঞ্চিত ৪ লাখ রুপি চুরি হয়। দ্বিতীয় দিন, আরও বড় দাঙ্গা হয়; একটি অস্থায়ী মসজিদ ধ্বংস করে দেওয়া হয়, একজন মুসলিমের গাড়ি নদীতে ছুঁড়ে ফেলা হয়।
দেহরাদুনে আশ্রয় নিয়ে হাসান ও তার সঙ্গী হাইকোর্টে রিট করেন। আদালত পুলিশকে সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নির্দেশ দেয়। এরপর সাহস করে স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে ফিরে আসেন হাসান। কিন্তু নন্দা নগর বদলে গেছে।
কোনো হিন্দু মিস্ত্রি তার দোকান মেরামত করতে রাজি হয়নি, কেউ কথা বলে না, দোকানের পাশে খোলা হয়েছে একটি হিন্দু ড্রাই-ক্লিনিং দোকান। “এমনকি ড্রাই-ক্লিনিংয়েরও ধর্ম আছে এখন,” বলেন হাসান।
বৌদ্ধিক সহিংসতা ও মানসিক দুঃসহ স্মৃতি
তার ১৬ বছর বয়সী মেয়েকে স্কুলে ধর্মের কারণে অপমান করা হয়েছে। মুসলিম হওয়ায় স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার দাবিও উঠেছে। স্কুলে অভিযোগের পর সে সমস্যা কিছুটা প্রশমিত হয়েছে।
নন্দা নগর থানার ওসি সঞ্জয় সিং নেগি দাঙ্গার দিন নিজের রিপোর্টে লিখেছিলেন যে ২৫০-৩০০ জনের জনতা মুসলিমদের বিরুদ্ধে গালাগালি করছে, তাকে ঠেলে ফেলে দেয় এবং মুসলিমদের দোকানপাট ভাঙচুর করে। কিন্তু এখনো কাউকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ।
বিজেপি শাসিত উত্তরাখণ্ডে মুসলিমদের সংকুচিত বাস্তবতা
উত্তরাখণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী পুষ্কর সিং ধামির নেতৃত্বে রাজ্যে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও সহিংসতা বেড়েছে। হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর চাপের মুখে একাধিক শহরে মুসলিমরা স্থান ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। অর্থনৈতিক বয়কট ও আক্রমণ যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে।
প্রতিদিনের এই শূন্যতার মাঝে ফেব্রুয়ারির এক সকালে হাসানের দোকানে আসে এক হিন্দু ব্যক্তি — যিনি আগের দাঙ্গার নেতৃত্বেও ছিলেন। তার স্ত্রীর কাছে জামাকাপড় ড্রাই-ক্লিন করার অনুরোধ জানান। হাসানের স্ত্রী প্রশ্ন করেন, “আপনি আমায় বোন বলতেন, আবার আমাদের তাড়াতে চেয়েছিলেন?” উত্তরে তিনি বলেন, “আগের কথা ভুলে যান। আপনার কাজ ভালো বলেই আমি এসেছি।”
হাসান বলেন, “আমি এই দিন দেখেছি কারণ আমি পালাইনি, আমি রয়ে গেছি। আমি লড়াই করেছি।”
“ভৌত সহিংসতা থেমে গেছে, কিন্তু সামাজিক সহিংসতা এখনো জারি”
হাসান জানেন, তার পুরনো বন্ধুরা আজ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। মুসলিম পরিবারগুলো যখন শহরে ফিরে এসে তাদের জিনিসপত্র নিতে এসেছিল, তখন পুরনো প্রতিবেশীরা ব্যঙ্গ করেছে — “কেন ফিরে এসেছ?” সেই আঘাত শরীরের নয়, মন ও স্মৃতিতে গেঁথে গেছে।
তবুও, হাসান এখনো নন্দা নগর ছাড়তে রাজি নন। “আমার জন্ম, পরিচয়, শিকড় এই শহরেই। আমি এখানেই থাকব।”