
মধ্যপ্রাচ্যে ইরান ও ইসরায়েলের চলমান সামরিক সংঘাতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে ইয়েমেনের সশস্ত্র হুথি বিদ্রোহী গোষ্ঠী আনসারুল্লাহ। তেহরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র এই গোষ্ঠী জানিয়েছে, তারা ইরানের সঙ্গে সমন্বয় করে ফিলিস্তিনিদের পক্ষে এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক হামলায় অংশ নিচ্ছে।
হুতিদের সামরিক মুখপাত্র ইয়াহিয়া সারি টেলিগ্রামে দেওয়া বিবৃতিতে বলেন, “আমাদের বাহিনী ইরানি প্রতিরক্ষা অভিযানের সঙ্গে সমন্বয়ে ইসরায়েলের জাফা শহরে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে।” এই হামলাকে তারা “ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতির প্রকাশ” হিসেবে অভিহিত করেছে।
২০২৩ সাল থেকে হুতিরা গাজা পরিস্থিতির প্রতিবাদে ইসরায়েল ও লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজের বিরুদ্ধে হামলা চালিয়ে আসছে।
হুতিদের হামলা ও প্রতিক্রিয়া
ইসরায়েল ১৩ জুন ইরানের সামরিক স্থাপনায় বিমান হামলা চালালে, তার দুই দিন পর হুতিরা ইসরায়েল লক্ষ্য করে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। হুতি-ঘনিষ্ঠ বিশ্লেষক হুসাইন আলবুখাইতি বলেন, “ইসরায়েলি নাগরিকরা যেন ফিলিস্তিনিদের আতঙ্ক অনুধাবন করে—এই বার্তা দিতেই হুতিদের এই পদক্ষেপ।”
যদিও বেশিরভাগ হামলা প্রতিহত করা হয়েছে, মে মাসে হুতিদের একটি ড্রোন তেলআভিভের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরে আঘাত করে, এতে ছয়জন আহত হয় এবং সাময়িকভাবে বিমান চলাচল বন্ধ থাকে।
মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক নিকোলাস ব্রামফিল্ড বলেন, “হুতিদের হামলা ইসরায়েলকে দক্ষিণাঞ্চলেও প্রতিরক্ষা মোতায়েন করতে বাধ্য করছে, ফলে ইরান থেকে আসা বৃহৎ আক্রমণ প্রতিহত করা আরও কঠিন হয়ে পড়েছে।”
লোহিত সাগর ও হরমুজ প্রণালী: একটি বিস্তৃত সামুদ্রিক সংঘাতের ইঙ্গিত
২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে হুতিরা রেড সি-তে ইসরায়েল-সম্পর্কিত জাহাজের উপর হামলা চালিয়ে আসছে। মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি অঘোষিত সমঝোতার পর এসব হামলা কমে আসে। তবে হুতিরা স্পষ্ট করে বলেছে, যদি যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলকে সহায়তা করে, তাহলে তারা ওই সমঝোতা আর মানবে না।
হুতির মুখপাত্র আলবুখাইতি বলেন, “যদি যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের অংশ হয়, তাহলে আমরা সেই সমঝোতা বাতিল করব—যেভাবে একসময় ট্রাম্প ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু চুক্তি বাতিল করেছিলেন।”
বিশ্বের তেল সরবরাহের ২০ শতাংশ হরমুজ প্রণালী দিয়ে যায়। ইরান ইতোমধ্যেই এ পথ বন্ধের হুমকি দিয়েছে। হুতিরাও একইভাবে লোহিত সাগর অবরোধের ইঙ্গিত দিয়েছে।
ব্রামফিল্ড সতর্ক করে বলেন, “সাগর-মাইন ব্যবহার করে হুতিরা সহজেই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে।”
২০১৫ সালে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোট হুতিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করে। যদিও ২০২২ সালে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হয়, তবে স্থায়ী শান্তিচুক্তি এখনো হয়নি। হুতিরা হুঁশিয়ার করে বলেছে, “আমেরিকার ঘাঁটি, সৌদি আরব ও আমিরাতের সামরিক স্থাপনা আমাদের টার্গেট হতে পারে।”
২০১৯ সালে হুতিদের ড্রোন হামলায় সৌদির তেল উৎপাদন ৫০% কমে গিয়েছিল। এমন আক্রমণের আশঙ্কা আবার দেখা দিয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, এই উত্তেজনাকে ঘিরে হুতিবিরোধী গোষ্ঠীগুলোর জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। তবে তারা এখনো সেই রকম ক্ষমতা অর্জন করেনি, যাতে তারা হুতিদের এলাকা দখল করে কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে পারে।
ইরান, ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও হুতিদের ক্রমবর্ধমান সংঘাতে পুরো মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে একটি বিস্তৃত যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। সামুদ্রিক বাণিজ্য, উপসাগরীয় নিরাপত্তা ও তেল সরবরাহ—সবই এখন হুমকির মুখে।