
রাজধানীর মিরপুরে জুলাইয়ের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত যুবক মো. জুনায়েদ হোসেনের মৃত্যু একটি জাতীয় আলোড়ন তুলেছিল। তবে সেই শহীদকে ঘিরে চলছে এখন শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলায় রাজনৈতিক উত্তেজনা, দানা বাঁধছে শত্রুতার নতুন গল্প। একদিকে শহীদ পরিবার ন্যায়বিচারের প্রত্যাশা করছে, অন্যদিকে অভিযুক্তরা বলছেন তারা এখন রাজনৈতিক প্রতিশোধের শিকার।
নিহত জুনায়েদ ছিলেন রাজনগর ইউনিয়নের বিলদেওনিয়া গ্রামের বাসিন্দা। ষষ্ঠ-শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা অর্জন করে, জীবিকার টানে ঢাকায় পারিজামান জুনায়েদ , কাজ করতেন মিরপুর-১০ নম্বরের একটি কম্পিউটার দোকানে। কিন্তু ১৯ জুলাইয়ের সেই উত্তাল ছাত্র আন্দোলনে মিরপুর এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে প্রাণ হারান তিনি। শহীদ জুনায়েদের মৃত্যুতে যেমন কান্না বয়ে গিয়েছিল তার গ্রামে, জুনায়েদ হত্যা মামলা দায়ের হওয়ায় স্থানীয় রাজনীতিতে এনে দিয়েছে চরম উত্তেজনা।
জুনায়েদ হত্যা মামলার আসামিদের তালিকায় মোট ৬৮ জন তার মধ্যে রয়েছেন রাজনগর ইউপি পরিষদ চেয়ারম্যান আবু আলেম মাদবর, তার ভাই আলমগীর মাদবর, আত্মীয় ইকবাল, কামাল ও সোহেল মাদবরসহ আরও কয়েকজন। তাদের অভিযোগ এটি শুধুমাত্র একটি ষড়যন্ত্র, যেখানে জমি সংক্রান্ত পুরনো বিরোধ আর রাজনৈতিক মতভেদকে কাজে লাগিয়ে তাদের ফাঁসানো হয়।
সরজমিনে গিয়ে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে জানা যায়। ইউপি চেয়ারম্যানকে জড়িয়ে মিথ্যা মামলা দেওয়ার বিষয়টি বর্তমানে। স্থানীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে মামলা দেওয়ার ঘটনায়। সংশ্লিষ্ট এলাকায় জনমনে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ও উদ্বেগ।
চলতি বছরের ঈদুল ফিতরের দিন, অর্থাৎ ৩১ মার্চ শহীদ জুনায়েদের বাড়িতে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। কিন্তু মিলাদ শেষে পরিস্থিতি হঠাৎ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। অভিযোগ উঠেছে, চেয়ারম্যান আবু আলেম মাদবরের বাড়িসহ আশপাশের কয়েকটি বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। এমনকি শহীদের কবরেও নাকি হামলার চেষ্টা করা হয়।
নিহত জুনায়েদের বাবা শাহ আলম ফরাজীর ভাষ্য, মিলাদের সময় কেউ পাশেই একটি চকলেট বোমা ফাটায়। এরপর চেয়ারম্যান আবু আলেম ও তার লোকজন আমাদের বাড়িতে হামলা চালায়। আমার ছেলের কবরেও ভাঙচুর করে।
অন্যদিকে, চেয়ারম্যানপক্ষ নিজেদের নির্দোষ দাবি করে উল্টো নিজেদেরকেই হামলার শিকার হিসেবে উল্লেখ করেছে। ইউপি চেয়ারম্যান আবু আলেম বলেন, ঘটনার দিন আমি অন্য একটি বৈঠকে ছিলাম। অথচ ষড়যন্ত্র করে আমাকে মামলায় জড়ানো হয়েছে। এটা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
মামলার আরেক আসামি, জয়পুরহাট জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মো. কামাল হোসেন বলেন, ঘটনার সময় আমি জয়পুরহাটে কর্মরত ছিলাম। আমাদের পুরনো জমি সংক্রান্ত বিরোধকে কাজে লাগিয়ে আমাকে এই মামলায় টেনে আনা হয়েছে।
চেয়ারম্যানের মেয়ে, যিনি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, দাবি করেন, ঈদের দিন আমাদের বাড়িতে হামলা চালানো হয়, ঘরবাড়ি ভাঙচুর করা হয়। অথচ আমাদেরকেই অভিযুক্ত করা হচ্ছে। এটা ঘৃণ্য অপপ্রচার।
অনুসন্ধানী তথ্য অনুযায়ী শহীদ জুনায়েদ নিহত হন সেইদিন ১৯ জুলাই শুক্রবার ছয়গাও ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান লিটন মোল্লার দাবি নিহত জুনায়েদ হত্যার ঘটনা যেদিন ঘটে, সেদিন শুক্রবার রাজনগর ইউপি চেয়ারম্যান জনাব আবু আলেম মাদবর সালিশ হিসেবে আমার পরিষদে বসা ছিলেন এবং বৈঠকে আরো বেশ কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
রাজনগর ইউপি সদস্যদের বক্তব্যের মধ্যে জোর দাবি করেছেন, এই মামলায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে চেয়ারম্যান আবু আলেমকে জড়ানো হয়েছে।
শহীদ জুনায়েদ হত্যার দিন চেয়ারম্যান আবু আলেম আমাদের সাথে ছিলেন, মিরপুর-১০ নাম্বার আন্দোলনের ঘটনাস্থলে ছিলাম না এবং এই ঘটনার সাথে চেয়ারম্যানের কোনো সম্পর্ক নেই।” তারা আরও বলেন, শহীদ জুনায়েদের মৃতদেহ দাফন কাফনের সময় চেয়ারম্যান উপস্থিত ছিল। এটি একটি রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফল। রাজনগর এলাকায় চেয়ারম্যান আবু আলেম মাদবরের জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী হওয়ায় কিছু মহল জনপ্রিয়তা ধ্বংস করতে চায়।”
স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা, রাজনৈতিক সহকর্মী এবং গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও এই অভিযোগকে সমর্থন করে বলেন, “চেয়ারম্যান সাহেব সব সময় এলাকাবাসীর পাশে ছিলেন। তিনি এমন জঘন্য অপরাধে জড়িত হতে পারেন না।”এতে একাধিক নিরীহ ব্যক্তিকে জুনায়েদ হত্যা মামলায় ফাঁসানো হয়েছে।
নিরপক্ষ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ইউপি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা এর আগেও একাধিকবার চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালিয়েছে। এবার সুযোগ পেয়ে মামলাটিকে ঢাল হিসেবে নিয়েছে এমন অভিযোগ স্থানীয় জনসাধারণ একাধিক ব্যক্তির মুখে।
মামলার চার্জশিটে ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শী বা নির্ভরযোগ্য সাক্ষ্য নেই। যা মামলাটির ভিত্তিকে অনেকটাই দুর্বল ও সন্দেহজনক করে তুলেছে।
জনমতের প্রতিফলন এলাকায় জনসাধারণের মাঝে বিভ্রান্তি ও ক্ষোভ বিরাজ করছে। একজন স্থানীয় নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা বিচার চাই, কিন্তু নিরীহ কাউকে ফাঁসানো হোক তা চাই না।”জুলাই গণহত্যার মত একটি হৃদয়বিদারক ঘটনাকে ঘিরে যদি কাউকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানো হয়, তবে তা ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যথাযথ তদন্ত ও সত্য উদ্ঘাটনের মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি।
মামলাটির নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্ত নিশ্চিত করতে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হোক, মিথ্যা মামলার প্রমাণ পেলে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক। নিরপরাধদের হয়রানি বন্ধে প্রশাসনের কার্যকর হস্তক্ষেপ। গণমাধ্যমে তথ্যভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি হোক এমনটা আশাবাদী।
এই ঘটনার পেছনে রয়েছে আরও গভীর প্রেক্ষাপট। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছিল একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিবাদের অংশ, যেখানে নিহত হয়েছিলেন জুনায়েদ। সেই শহীদের স্মৃতিকে ঘিরে যখন সম্মান ও বিচার দাবি ওঠা উচিত ছিল, তখন সেটি পরিণত হয়েছে স্থানীয় শত্রুতার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের ঘটনায়।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শরীয়তপুর জেলা আহ্বায়ক ইমরান আল নাজির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য করেছেন, “শহীদ জুনায়েদকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে কিছু কুচক্রী মহল অস্থিরতা তৈরি করছে। আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।”
ঘটনার বিষয়ে নড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসলাম উদ্দিন মোল্লার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার পক্ষ থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, ঘটনা দুটি তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে। যেন শহীদের পরিবার ন্যায়বিচার পায়।
একজন শহীদের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে যদি সামাজিক ও রাজনৈতিক শান্তি বিঘ্নিত হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠে আমরা আদৌ শহীদের মর্যাদা দিতে পারছি তো? নাকি নিজেদের স্বার্থে তাকে ব্যবহার করে চলেছি? শহীদ জুনায়েদ আজ একটি প্রতীক ন্যায়বিচারের, প্রতিবাদের, আবার একইসঙ্গে শঙ্কিত বাস্তবতার।