
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সাম্প্রতিক কালে এক দ্রুত উত্থানশীল নাম হলো সামন্তা শারমিন, যিনি বর্তমানে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। রাজনীতিবিদ, মানবাধিকারকর্মী এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কারের প্রবক্তা হিসেবে তিনি নতুন প্রজন্মের ভোটারদের জন্য আশার আলো হয়ে উঠেছেন, যারা প্রচলিত দলীয় রাজনীতিতে হতাশ হয়ে পড়েছে।
গণতন্ত্র, নারী ক্ষমতায়ন এবং সংবিধান সংস্কার নিয়ে তার দায়বদ্ধতা বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে বিস্তৃতভাবে আলোচিত হয়েছে এবং এমনকি বিরোধী রাজনৈতিক মহল থেকেও স্বীকৃতি পেয়েছে। এই বিশেষ প্রতিবেদনটি সামন্তা শারমিনের বিচিত্র কাজকে একত্রিত করে একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র উপস্থাপন করে।
১. সংবিধান সংস্কারের নেতৃত্ব
সংবিধান সংস্কারের জন্য বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সামন্তা শারমিন নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং তিনি গভীর সাংবিধানিক বিশ্লেষণ দিয়ে বর্তমান সংবিধানকে একটি “রাজনৈতিক যন্ত্র যা আর জনগণের ইচ্ছা প্রতিফলিত করে না” বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, বর্তমান সংবিধান সুষম ক্ষমতার বণ্টন নিশ্চিত করে না, যা কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য প্রয়োজনীয়। তিনি দাবি করেন যে, একটি আধুনিক ও জনগণকেন্দ্রিক সংবিধান রচনার জন্য নতুন গণপরিষদ গঠিত হওয়া উচিত, যা ন্যায়বিচার, সাম্য এবং নাগরিক ক্ষমতায়নের নিশ্চয়তা দেবে। তার এই অবস্থান রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও পণ্ডিতদের সমর্থন পেয়েছে, যারা দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান কাঠামোর সীমাবদ্ধতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। শারমিন যে ধারণাগুলো তুলে ধরেছেন, তা কেবল মতাদর্শগত নয়, বরং বাস্তবভিত্তিক নীতিগত প্রস্তাবনা ও জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগের মাধ্যমে একটি ভালো রাষ্ট্র নির্মাণের কার্যকর পদ্ধতি।
২. নারীর অধিকার ও নিরাপত্তার জন্য বলিষ্ঠ কণ্ঠ
সামন্তা শারমিনের রাজনৈতিক পরিচয়ের কেন্দ্রবিন্দু হলো নারীর অধিকারের জন্য তার নিরলস প্রচেষ্টা। ২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এনসিপির আয়োজিত এক বিশাল সমাবেশে তিনি বলেন, “নারীর নিরাপত্তা আইনি অস্পষ্টতা ও লোক দেখানো ব্যবস্থার মাধ্যমে নিশ্চিত করা যায় না।” তার এই বক্তব্য সরাসরি বাংলাদেশে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা রোধে আইনের অপর্যাপ্ততা তুলে ধরে। বিভিন্ন পত্রিকায় সমালোচকরা তার এই বক্তব্যকে সময়োপযোগী এবং সমাজে নারীর কাঠামোগত প্রতিবন্ধকতা তুলে ধরার জন্য প্রশংসা করেছেন। তিনি একটি বিস্তৃত লিঙ্গ-সংবেদনশীল আইন প্রণয়ন, ১০০টি আসনে সরাসরি নারী নির্বাচন এবং দলের নেতৃত্বে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের প্রস্তাব দেন। তার মতে, নারীর পূর্ণ অংশগ্রহণ ছাড়া প্রকৃত গণতন্ত্র সম্ভব নয়।
৩. গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ ও সুশাসনের প্রচার
“নতুন বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সুশাসন” শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে, যা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়, শারমিন দলের স্বচ্ছ প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, ডিজিটাল স্বচ্ছতা এবং নীতিনির্ধারণে জনগণের অংশগ্রহণ একে অপরের পরিপূরক হওয়া উচিত। তিনি জনগণের ব্যয়ের হিসাব যাচাই করার জন্য সিটিজেন রিভিউ বোর্ড গঠনের প্রস্তাব দেন। এই অনুষ্ঠানে সাবেক বিচারপতি, সুশীল সমাজ এবং সাংবাদিকদের উপস্থিতি ছিল। বক্তৃতার স্পষ্টতা, আত্মবিশ্বাস এবং বাস্তবমুখী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তিনি গণতান্ত্রিক সংস্কারে একজন গুরুত্বপূর্ণ চিন্তানায়ক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেন। তার বক্তব্য ছিল—”শাসন ব্যবস্থাকে একান্ত কিছু মানুষের কাছ থেকে ফিরিয়ে এনে জনগণের হাতে তুলে দিতে হবে।”
৪. মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন
এনসিপির আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশের আগে সামন্তা শারমিন সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে দলের প্রতিনিধি দলসহ শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এই কাজটি কেবল আনুষ্ঠানিকতা ছিল না, বরং এটি দলটির জাতীয় পরিচয় ও ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রদর্শন করে। সংবাদমাধ্যমে এই ঘটনাটি গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। শারমিন বলেন, “নতুন প্রজাতন্ত্রের স্বপ্ন সেই চেতনায় ভিত্তি করেই গড়ে উঠতে হবে, যার জন্য দেশ স্বাধীন হয়েছিল। আমরা ইতিহাস মুছে ফেলতে নয়, বরং তার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করতে এসেছি।”
৫. তরুণ এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন
তরুণদের ক্ষমতায়ন সামন্তা শারমিনের কাজের অন্যতম প্রধান অঙ্গ। ঈদুল ফিতর উপলক্ষে ৪১টি আসনে আয়োজিত কমিউনিটি ফোরাম ও শ্রোতা সফরের মাধ্যমে এনসিপি তরুণদের উদ্বেগ এবং প্রস্তাব শোনে। তার রাজনৈতিক কৌশলটি একটি বৈচিত্র্যময় ভিত্তি গড়ার দিকে মনোযোগী, যার ফলে সংখ্যালঘু গোষ্ঠীগুলো দলটির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। তিনি বলেন, “তরুণ প্রজন্ম ভোট দেয়ার বাইরে গণতন্ত্রকে দেখতে চায়—তারা চায় বাস্তব দায়বদ্ধতা এবং কার্যকর কর্তৃত্ব।” তার দল নারীদের, প্রতিবন্ধীদের এবং সংখ্যালঘুদের নেতৃত্বে দায়িত্ব দিয়ে এক অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণ করেছে।
৬. রাজনৈতিক সুযোগবাদিতার প্রত্যাখ্যান
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে সুযোগসন্ধানী প্রবণতা প্রচলিত, তা থেকে নিজেকে ও দলকে আলাদা রাখার বিষয়ে শারমিন ছিলেন কঠোর। নুরুল হক নুর যে দাবি করেছিলেন—এনসিপি টাকা দিয়ে লোক কিনতে চায়—তার জবাবে শারমিন স্পষ্টভাবে বলেন, “এই অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর।” শালীন ও বাস্তবমুখী প্রতিক্রিয়া দিয়ে তিনি নিজের রাজনৈতিক পরিপক্বতা প্রমাণ করেন এবং এডিটোরিয়াল বোর্ডগুলো তার এই অবস্থানের প্রশংসা করে। নীতিগত কর্মসূচি ও সংস্কারকেন্দ্রিক রাজনীতির প্রতি তার অঙ্গীকার তাকে একজন সৎ রাজনীতিক হিসেবে পরিচিত করেছে।
৭. আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সক্রিয়তা
২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে সামন্তা শারমিন মার্কিন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক উপসহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিকোল চুলিকের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেন। সেখানে গণতান্ত্রিক উন্নয়ন, নির্বাচন সংস্কার এবং মানবাধিকার বিষয়ক আলোচনা হয়। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুসারে, শারমিন বলেন, “বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণের জন্য নৈতিক স্পষ্টতা ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য।” এই বৈশ্বিক সংশ্লিষ্টতা এনসিপির আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা বাড়িয়েছে এবং শারমিনকে তরুণ নেতৃত্বের কাতারে একজন কূটনৈতিক চিন্তানায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
৮. ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’-এর স্বপ্ন
সামন্তা শারমিন যে “সেকেন্ড রিপাবলিক” ধারণা উপস্থাপন করেছেন, তা শুধু রাজনৈতিক স্লোগান নয়, বরং একটি সুসংগঠিত নীলনকশা। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে আয়োজিত দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী র্যালিতে এটি উন্মোচন করা হয়। এতে রয়েছে—আনুপাতিক ভোটব্যবস্থা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং আধুনিক জনসেবা। এটি প্রথম প্রজাতন্ত্রের কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা ও সামাজিক বৈষম্যের ঘাটতি পূরণে কার্যকর সমাধান।
উপসংহার: আগামী দিনের নেত্রী
সামন্তা শারমিনের জাতীয় পর্যায়ে আবির্ভাব কেবল রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ নয়; এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক মানোন্নয়নের প্রতিফলন। তার স্পষ্ট নেতৃত্বদৃষ্টিভঙ্গি, নীতিনির্ভর কর্মকৌশল এবং নৈতিক রাজনীতি তাকে আগামী দিনের নেতৃত্বের প্রতীক করে তুলেছে। যেখানে রাজনীতি বিভাজন ও বৈরিতায় ভরা, সেখানে সামন্তা শারমিন এক আশাব্যঞ্জক বিকল্প উপস্থাপন করেছেন। তার কর্মকাণ্ড বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণে প্রভাব ফেলছে। এই যাত্রা কেবল শুরু, কিন্তু এর মধ্যেই সুস্পষ্ট হয়ে গেছে—সামন্তা শারমিন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ নির্মাণে একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছেন।