
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আনুষ্ঠানিক বিচার কার্যক্রম শুরু করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সম্প্রতি গঠিত এই মামলায় তাঁকে “নির্দেশদাতা” এবং “মাস্টারমাইন্ড” হিসেবে উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনাল তিনজন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে দাখিল করা অভিযোগ আমলে নিয়েছে। এর মাধ্যমে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো কোনো আদালতে বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হলো।
এই মামলার অন্য দুই অভিযুক্ত হলেন — সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। মামলায় চৌধুরী মামুন বর্তমানে গ্রেফতার অবস্থায় রয়েছেন। শেখ হাসিনা ও কামালের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।
পাঁচটি অভিযোগ, ৮ হাজার পৃষ্ঠার প্রমাণ
১৩৫ পৃষ্ঠার আনুষ্ঠানিক অভিযোগপত্রে মোট পাঁচটি গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে নির্বিচার হত্যা, পরিকল্পিত দমন-পীড়ন, উসকানি ও নির্দেশনা। প্রমাণ হিসেবে ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হয়েছে ৮,৭৪৭ পৃষ্ঠার তথ্য-উপাত্ত, যার মধ্যে রয়েছে ভিডিও, অডিও কল, লিখিত প্রমাণ এবং প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষ্য। সাক্ষী করা হয়েছে ৮১ জনকে।
‘বর্ষা বিপ্লব’ ও হত্যাযজ্ঞের অভিযোগ
মামলার পটভূমি ২০২৪ সালের জুলাই–অগাস্টে সংঘটিত ‘বর্ষা বিপ্লব’ বা ‘মনসুন বিপ্লব’কে কেন্দ্র করে। আন্দোলনকারীদের দমন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং রাজনৈতিক সংগঠনের সমন্বয়ে যে পদ্ধতিগত সহিংসতা চালানো হয়, তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করেছে তদন্ত সংস্থা।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ সময় নির্বিচারে ১,৪০০-এর বেশি মানুষ নিহত হয় এবং এর পেছনে নির্দেশদাতা হিসেবে শেখ হাসিনার নাম উঠে এসেছে। তাঁকে ‘সুপিরিয়র কমান্ডার’ হিসেবে উল্লেখ করে চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, “এই বিচার কোনো প্রতিশোধ নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য একটি প্রতিজ্ঞা—যাতে মানবতাবিরোধী অপরাধ আর না ঘটে।”
ট্রাইব্যুনালে সরাসরি সম্প্রচার
রোববার (১ জুন) দুপুর ১২টা ১৫ মিনিটে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিলের শুনানি শুরু হয়। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন বিটিভি থেকে তা সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। এর আগে, ১২ মে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয় প্রসিকিউশন টিম।
চিফ প্রসিকিউটর জানান, “শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে হলেও এগুলো সরাসরি মানবতাবিরোধী অপরাধের আওতাভুক্ত।” তিনি আরও জানান, “যারা ইতিহাসে নির্যাতিত, তারাই আজ অভিযুক্তদের বিচারের দাবিতে এই ট্রাইব্যুনালের সামনে।”
শেখ হাসিনার জন্য নির্মিত ট্রাইব্যুনালেই বিচার শুরু
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই সেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল—যার সূচনা হয় শেখ হাসিনার সরকার কর্তৃক ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য। আজ সেই একই ট্রাইব্যুনালেই বিচার শুরু হচ্ছে তাঁর বিরুদ্ধে, মানবতাবিরোধী অপরাধে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই মামলার প্রভাব বাংলাদেশে রাজনৈতিক ও বিচারিক ইতিহাসে এক যুগান্তকারী পালাবদলের সূচনা করতে পারে।