
পৃথিবীর তিন-পবিত্র স্থান শ্রেষ্ঠ ৩ মসজিদ
ধর্ম ডেস্ক :
পৃথিবীর প্রথম মসজিদ হলো কাবায় অবস্থিত মুসলিমদের প্রাণকেন্দ্র বাইতুল্লাহ। আল্লাহ তায়ালা বলেন,
إِنَّ أَوَّلَ بَيْتٍ وُضِعَ لِلنَّاسِ لَلَّذِي بِبَكَّةَ مُبَارَكًا وَهُدًى لِّلْعَالَمِينَ
‘নিঃসন্দেহে সর্বপ্রথম মানুষের জন্যে নির্ধারিত ঘর সেটাই, যা মক্কায় অবস্থিত এবং সারা বিশ্বের মানুষের জন্য হিদায়াত ও বরকতপূর্ণ। [সুরা আলি ইমরান, ৩ : ৯৬]
একবার মদিনার ইহুদিরা মুসলিমদের সাথে বিতর্কে লিপ্ত হলো যে, তাদের কিবলা বাইতুল মুকাদ্দাস মুসলিমদের কিবলা বাইতুল্লাহ থেকে উত্তম। তখন আল্লাহ তায়ালা এই আয়াত নাজিল করে তাদের জানিয়ে দিলেন যে, পৃথিবীতে স্থাপিত প্রথম ঘরের মর্যাদা কিন্তু এই কাবার।
কবে, কখন নির্মিত হয়েছিল কাবা—এ নিয়ে তাফসিরের কিতাবাদিতে বিভিন্ন বর্ণনা এসেছে। মুজাহিদ (রহ.) বলেন, ‘পৃথিবী সৃষ্টির দুহাজার বছর আগে আল্লাহ কাবাকে সৃষ্টি করেছেন।’ মাওলা আলি ইবনু আবি তালিব (রা.) বলেন, “আদম সৃষ্টিরও আগে আল্লাহ তায়ালা ফিরিশতাদের বললেন, ‘যাও, যমিনে একটা ঘর নির্মাণ করো এবং সেটার তাওয়াফ করো।’ পরবর্তীতে আদম আলিইহিস সালামও সে ঘরের নির্মাণকাজ করেন এবং তাওয়াফ করেন। এরপর নবিরা সেই ধারা অব্যাহত রাখেন। সর্বশেষ ইবরাহিম (আ.) কাবাঘরের নির্মাণকাজ সমাপ্ত করেন।” আলি ইবনুল হুসাইন (রহ.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, ‘আল্লাহ তায়ালা আরশের ঠিক বরাবর নিচে একটি ঘর স্থাপন করেছেন, যার নাম বাইতুল মামুর। আর ফিরিশতাদেরকে আদেশ করেছেন সেই ঘরের তাওয়াফ করতে। এরপর আল্লাহ ফিরিশতাদের আদেশ করলেন পৃথিবীতে ঠিক এ ধরনের আরেকটি ঘর স্থাপন করতে, যাতে মানুষেরা তার তাওয়াফ করে, যেমনিভাবে ফিরিশতারা বাইতুল মামুরের তাওয়াফ করে।’
আবু যার (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে এসেছে, একবার তিনি নবিজিকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘ইয়া রাসুলাল্লাহ! প্রথম নির্মিত মসজিদ কোনটি?’ উত্তরে রাসুল (সা.) বললেন, ‘মসজিদুল হারাম।’ তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, ‘এরপর কোনটি?’ নবিজি (সা.) বললেন, ‘মসজিদুল আকসা।’ আবু যার (রা.) এবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘উভয়টি নির্মাণের মাঝে ব্যবধান ছিল কত বছর?’ তিনি বললেন, ‘চল্লিশ (বছর)।’ এরপর তিনি আরও বললেন, ‘যেখানেই সালাতের সময় হবে, সেখানেই তুমি সালাত আদায় করে নেবে। সেটাই তোমার জন্য মসজিদ।’
মোটকথা পৃথিবীর প্রথম মসজিদ হচ্ছে মসজিদুল হারাম বা বাইতুল্লাহ। কিন্তু মসজিদুল হারাম ও মসজিদুল আকসা নির্মাণের মাঝের ব্যবধানের ব্যাপারে যে বলা হলো, তা ছিল চল্লিশ বছর। অথচ আমরা জানি যে, মসজিদুল হারাম নির্মাণ করেছিলেন ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.) আর মসজিদুল আকসা নির্মাণ করেছিলেন সুলাইমান (আ.)। ইতিহাস বলে, তাদের মাঝে সময়ের ব্যবধান ছিল এক হাজার বছরেরও বেশি সময়। এ হাদিসের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনুল কাইয়িম (রহ.) বলেন,
“এ হাদিসটি তাদের জন্য বোঝা কষ্টকর যারা এর উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানে না। কেউ হয়তো বলতে পারে—‘এ তো সবাই জানে যে, নবি সুলাইমান (আ.) মসজিদুল আকসা নির্মাণ করেন। আর ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর মাঝে সময়ের ব্যবধান ছিল প্রায় হাজার বছর।’ আসলে এ কথার দ্বারা ব্যক্তির অজ্ঞতাই স্পষ্ট হয়। কেননা সুলাইমান (আ.) তো শুধুমাত্র আল-আকসাকে পূনঃনির্মাণ ও নতুন রূপ দান করেছিলেন। তিনি মোটেও সর্বপ্রথম এটি প্রতিষ্ঠা করেননি বা নির্মাণ করেননি। বরং যিনি প্রকৃতপক্ষে এটি (সর্বপ্রথম) নির্মাণ করেন তিনি হচ্ছেন ইয়াকুব বিন ইসহাক (আ.)। এবং এটি ছিল মক্কায় ইবরাহিম (আ.) কাবা বিনির্মাণের পরবর্তী কালে।”
অর্থাৎ নবি ইয়াকুব (আ.) হচ্ছেন বাইতুল মুকাদ্দাস মসজিদের সর্বপ্রথম গোড়াপত্তনকারী। তিনি ছিলেন নবি ইবরাহিম (আ.) এর নাতি। দাদা ও নাতির কাজের মাঝে ৪০ বছরের ব্যবধান থাকা খুবই সম্ভব। কাজেই হাদিসে কাবা ও আকসার মাঝে ৪০ বছরের ব্যবধানের তথ্যের সঙ্গে এই তথ্য পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ।
মসজিদুল হারামে সালাত আদায় অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ। জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
…وَصَلاَةٌ فِي الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ أَفْضَلُ مِنْ مِائَةِ أَلْفِ صَلاَةٍ فِيمَا سِوَاهُ
‘মসজিদুল হারামে এক ওয়াক্ত সালাত আদায় করা, অন্যান্য মসজিদে এক লক্ষ সালাত আদায়ের চেয়ে উত্তম।’
মসজিদুন নববি
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
إِنَّ إِبْرَاهِيمَ حَرَّمَ مَكَّةَ وَإِنِّي حَرَّمْتُ الْمَدِينَةَ
‘নিশ্চয়ই ইবরাহিম (আ.) মক্কাকে হারাম (পবিত্র) ঘোষণা দিয়েছেন, আর আমি মদিনাকে হারাম ঘোষণা করলাম।’
মসজিদুন নববিতে সালাতের ফজিলতের ব্যাপারে হাদিসে এসেছে,
عَنِ ابْنِ عُمَرَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ “ صَلاَةٌ فِي مَسْجِدِي هَذَا أَفْضَلُ مِنْ أَلْفِ صَلاَةٍ فِيمَا سِوَاهُ إِلاَّ الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ
ইবনু উমর (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার মসজিদে (মসজিদে নববি) এক ওয়াক্ত সালাত আদায় করা পৃথিবীর অন্য যেকোন মসজিদে এক হাজার সালাত আদায়ের চেয়ে উত্তম, তবে মসজিদুল হারাম ব্যতীত।’
শেষ যামানায় ইমান থাকবে মদিনায়। আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
إِنَّ الإِيمَانَ لَيَأْرِزُ إِلَى الْمَدِينَةِ كَمَا تَأْرِزُ الْحَيَّةُ إِلَى جُحْرِهَا
‘নিশ্চয়ই ইমান মদিনার দিকে ফিরে আসবে, যেমনিভাবে সাপ তার গর্তে ফিরে আসে।’
মসজিদুন নববিতে এমন এক টুকরো যমিন রয়েছে, যাকে রাসুল (সা.) জান্নাতের উদ্যানসমূহের একটি উদ্যান বলে বিশেষিত করেছেন। তিনি বলেছেন,
ما بينَ بَيْتِيْ ومِنْبَرِيْ رَوضَةٌ من رِيَاضِ الجَنَّةٍ
‘আমার ঘর এবং মিম্বরের মাঝখানের অংশটুকু জান্নাতের উদ্যানসমূহের একটি উদ্যান।’
মসজিদুল আকসা
আল্লাহ তায়ালা বলেন,
سُبْحَانَ الَّذِي أَسْرَى بِعَبْدِهِ لَيْلاً مِّنَ الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ إِلَى الْمَسْجِدِ الأَقْصَى الَّذِي بَارَكْنَا حَوْلَهُ لِنُرِيَهُ مِنْ آيَاتِنَا إِنَّهُ هُوَ السَّمِيعُ البَصِيرُ
পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যান্ত—যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল। [সুরা বনি ইসরাইল, ১৭ : ১]
আনাস ইবনু মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন,
وَصَلاَةٌ فِي الْمَسْجِدِ الأَقْصَى بِخَمْسِينَ أَلْفِ صَلاَةٍ
‘মসজিদুল আকসায় এক ওয়াক্ত সালাত ৫০ হাজার সালাতের সমান।’
মসজিদুল আকসা বা বাইতুল মুকাদ্দাস ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ। যেটি জেরুসালেমের পুরনো শহরে অবস্থিত। মুহাম্মদ (সা.) মিরাজের রাতে মসজিদুল হারাম থেকে আল-আকসা মসজিদে এসেছিলেন এবং এখান থেকে তিনি ঊর্ধ্বাকাশের দিকে যাত্রা করেন। আগেও আমরা দেখিয়েছি যে, এটি নির্মাণ করেছিলেন নবি ইসহাক (আ.)। আর পুনর্নির্মাণ ও পরিপূর্ণ করেছিলেন নবি সুলাইমান আলাইহিস সালাম। এটি মুসলিমদের প্রথম কিবলা।
খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাবের আমলে জেরুসালেম বিজয় হলে বর্তমান মসজিদের স্থানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। পরবর্তীতে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিকের যুগে মসজিদটি পুনর্নির্মাণ ও সম্প্রসারিত হয়। ৭৪৬ খ্রিস্টাব্দে ভূমিকম্পে মসজিদটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে আব্বাসীয় খলিফা আল মনসুর এটি পুনর্নির্মাণ করেন। পরে খলিফা আল-মাহদি এর পূনর্নির্মাণ করেন। ১০৩৩ খৃস্টাব্দে আরেকটি ভূমিকম্পে মসজিদটি ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফাতিমি খলিফা আলি আজ-জাহির পুনরায় মসজিদটি নির্মাণ করেন, যা অদ্যবধি টিকে আছে।
১০৯৯ খ্রিস্টাব্দে ক্রুসেডাররা জেরুজালেম দখল করার পর তারা মসজিদটিকে একটি প্রাসাদ এবং মসজিদ প্রাঙ্গণে অবস্থিত কুব্বাতুস সাখরাকে গির্জা হিসেবে ব্যবহার করত। মুসলিম বীর সুলতান সালাহউদ্দিন জেরুসালেম পুনরায় জয় করার পর মসজিদ হিসেবে এর ব্যবহার পুনরায় শুরু হয়। আইয়ুবি, মামলুক, উসমানি, সুপ্রিম মুসলিম কাউন্সিল ও জর্ডানের তত্ত্বাবধানে এর নানাবিধ সংস্কার করা হয়। বর্তমানে পুরনো শহরটি ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ইসলামের তৃতীয় বৃহত্তম ঐতিহাসিক এ কেন্দ্রটির ওপর চলছে যায়োনিস্ট ইহুদিদের আগ্রাসন।